নিজস্ব প্রতিনিধি:

‘মেয়ের বিয়ের গয়নার জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা জমাচ্ছিলাম। দুই বছরে জমেছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার। এখন এক ভরি সোনার দামই ১ লাখ ৭০ হাজার। এই টাকায়তো এক ভরি গয়নাও হবে না।’ হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন বগুড়ার চকফুলবাড়ির গৃহিণী নাজমা বেগম।
সোনার দাম বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। আর সেই দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লাগছে মধ্যবিত্তের গায়ে। যারা বিয়ে, ঈদ বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য সোনা কিনতে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য এখন এটি ‘দূরের তারা’।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি
২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) নির্ধারিত সোনার সর্বশেষ মূল্য অনুযায়ী ২২ ক্যারেট: ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৬ টাকা, ২১ ক্যারেট: ১ লাখ ৬১ হাজার ৩০১ টাকা, ১৮ ক্যারেট: ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৫৩ টাকা, আর সনাতন ১ লাখ ১৪ হাজার ২৯৬ টাকা।
বগুড়ার সাতমাথা, গালাপট্টি, নিউমার্কেট, হকার্স মার্কেটসহ শহরের প্রায় সব দোকানে এই দাম কার্যকর রয়েছে। সোনার এই মূল্যবৃদ্ধি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো নিজেদের রিজার্ভে সোনা যুক্ত করায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। সেই প্রভাব সরাসরি পড়ছে বাংলাদেশেও।
সোনার দোকানের চিত্র
এক সময় বগুড়া শহরের সাতমাথা, চকসুত্রাপুর, হকার্স মার্কেট ও নিউ মার্কেট এলাকাজুড়ে সোনার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যেত। ঈদ, পূজা বা বিয়ের মৌসুম এলেই দোকানে ঢোকা কঠিন হয়ে পড়ত। বিভিন্ন ছোট বড় জুয়েলার্স ছিল, যেখানে অনেকে নিজস্ব ডিজাইন বানিয়ে নিতেন। কিন্তু বর্তমানে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। দোকান আছে, আলো ঝলমলে সাজসজ্জাও আছে, কিন্তু ভিড় নেই। বিক্রিও নেই। এখন অনেক দোকানেরই র্যাক ফাঁকা দেখা যায়।
সাতমাথার ‘রূপা জুয়েলার্স’র মালিক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন ১৫-২০ ভরি সোনা বিক্রি হতো, এখন হয়ত সপ্তাহে ৪-৫ ভরি বিক্রি হয়। অনেকে দাম শুনেই চলে যান।
চকফুলবাড়ি মোড়ের ‘সোনালী গয়না ঘর’র মালিক জামাল মিয়া বলেন, মানুষ আসে, দাম জিজ্ঞেস করে, তারপর চুপচাপ চলে যায়। কিছু মানুষ পুরাতন গয়না ভেঙে নতুন করে বানান। এভাবেই চলছে।
হকার্স মার্কেটের ‘তাসনিম জুয়েলার্স’র মালিক রুবেল শেখ বলেন, গয়নার ডিজাইন বা মানে সমস্যা নেই, সমস্যা হলো দামে। এই রকম দাম হলে সাধারণ মানুষতো সোনা কিনতে পারবে না, আমরাও টিকবো না।
চকসুত্রাপুর এলাকার ‘আল-আমিন জুয়েলার্স’র মালিক সোহেল জানান, এই হাই প্রাইজে গয়না বিক্রি বন্ধ প্রায়। কাস্টমাররা দেখে চলে যায়। অনেকে আবার পুরাতন গয়না ভেঙে নতুন বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে লাভ নাই।
সোহেল বলেন, বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং ডলারের অবমূল্যায়ন ঠেকাতে অনেক দেশ স্বর্ণ কিনে নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। ফলে চাহিদা বাড়ছে এবং সরবরাহ আগের মতো না থাকায় দাম দ্রুত বাড়ছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধজনিত অনিশ্চয়তা, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এক আলোচনায় বলেছিলেন, সোনা হচ্ছে মানুষের শেষ আশ্রয়। যখন কিছুই নিরাপদ না থাকে, তখন মানুষ সোনার দিকে ছোটে। এখন তারই প্রমাণ মিলছে।
মধ্যবিত্তের ওপর প্রভাব
সদর এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, মেয়ের জন্য দুই ভরি গহনা বানাবো ভাবছিলাম। এখন এক ভরির খরচ আগের দুই ভরির সমান। তাও আবার দোকানে দাম প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে।
বিয়াম মোড়ের প্রাইভেট কোম্পানির কর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, স্ত্রীকে সোনার একটা লকেট আর চেইন দিতে চেয়েছিলাম ঈদে। দাম শুনে পকেটেই হাত দিতে ভয় লাগে এখন।
বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তাসনুভা নাজনীন বললেন, প্রতিবছর টাকা জমিয়ে এক ভরি করে সোনা কিনতাম। এ বছর তাও সম্ভব হচ্ছে না। ইনফ্লেশন আর এই সোনার বাজার, মধ্যবিত্তের কোনো দিকেই রেহাই নেই।
সদর উপজেলার কাঁঠালতলা এলাকার গৃহিণী মিনারা বেগম জানান, ছেলের বিয়েতে মেয়ের মতো করে গয়না দিতে চেয়েছিলাম। এখন ভাবছি শুধু একটা আংটি দিলেই হবে।
বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ
প্রতি ভরির দাম এক লাখ ৭০ হাজার ছোঁয়ায় সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনা। আয় বাড়েনি কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম ও জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়েছে, সঞ্চয় কমেছে। অনেকে মনে করছেন দাম স্থিতিশীল নয়, ফলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। এছাড়া মানুষ ব্যাংক ডিপোজিট, মোবাইল ব্যাংকিং সঞ্চয় বা ডিজিটাল সেবার দিকে ঝুঁকছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন অনেক ছোট ব্যবসায়ী জুয়েলার্স ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। বড় দোকানগুলো টিকে আছে কেবল আগের সঞ্চিত পুঁজি ও কিছু নির্ভরযোগ্য ক্রেতার কারণে। অনেকেই বলছেন, সরকারিভাবে স্বর্ণ বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে না পারলে তারা ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন না। আগে শুধু বগুড়া শহরে সাড়ে ৩ শতাধিক সোনার দোকান ছিল। এখন সেটি ৩০০তে নেমেছে। উপজেলায় দোকানের সংখ্যা ছিল চারশোর ওপর। সেই সংখ্যাও অর্ধেকে নেমেছে।
বগুড়া জেলা জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, আমরা চাই সোনা আমদানির ওপর কর-কাঠামো সহজ হোক, যাতে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। না হলে আমরা সবাই এই ব্যবসা থেকে ছিটকে যাবো।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, স্বর্ণের দাম সহসা কমার সম্ভাবনা নেই। ফলে সাধারণ সঞ্চয়দার মধ্যবিত্তদের জন্য বিকল্প চিন্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবীদ আবুল হাশেম বলেন, যারা প্রতি বছর কিছু সোনা কিনে রাখতেন, তাদের জন্য ব্যাংক সঞ্চয়পত্র, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিজিটাল গোল্ড ইনভেস্টমেন্টের কথা ভাবা যেতে পারে। সময় এখন বিকল্প চিন্তার।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বগুড়ার সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, সোনা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও নিরাপদ সঞ্চয়ের প্রতীক। কিন্তু যখন এর দাম এতটাই বেড়ে যায় যে সেটি আর সাধারণ মানুষের নাগালে থাকে না, তখন তা হয়ে ওঠে আর্থিক বৈষম্যের প্রতীক। আর বগুড়ার মধ্যবিত্তরা এখন স্বপ্নের গয়না নয়, নিত্যপ্রয়োজন মেটাতেই ব্যস্ত। এক সময় যে সোনা ছিল সঞ্চয়ের প্রতীক, এখন তা হয়ে উঠেছে চাপ ও দুশ্চিন্তার উৎস।